একবার আমাদের এদিকে টমেটো খুব সস্তা হয়ে গেল। আমার বাসায় সারাদিন টমেটোর আলোচনা। আমার আব্বা-আম্মার প্রতিদিনের রুটিন হয়ে গেল আজকে বাজারে টমেটো কেজি কত করে বিক্রি হচ্ছে সেই খবর রাখা। একদিন নাকি টমেটো দুই টাকা করে কেজি বিক্রি হচ্ছিল, আব্বা কিনেননি, সেটা শুনে আমার আম্মা গেলেন ক্ষেপে, দুই টাকা কেজি হওয়া সত্ত্বেও কেন টমেটো কেনা হলো না সেই আলোচনা বাসায় ঘুরে ফিরে আসতে লাগল। আরেকদিন বাসায় একটা আলমিরা কেনা হলো। সকাল থেকে রাত অবধি আমি শুধু আলমিরার আলোচনা শুনলাম। আলমিরার রং, ড্রয়ার, আয়না, কোথায় বসানো হবে, কোন পজিসনে কীভাবে বসালে ভালো দেখাবে, আলমিরায় কি কি রাখা হবে, পুরো একটি দিন এসব আলোচনা করে কাটল।
.
আমি অবাক হয়ে খুঁজে বের করার চেষ্টা করলাম এমন কেন হচ্ছে? সামান্য টমেটো আলোচনার বিষয়বস্তু, একটা আলমিরা নিয়ে সবাই ব্যস্ত! আমার মনে হয় আমাদের বেশিরভাগেরই এই অবস্থা। প্রত্যেক ঘরেই কমবেশি এরকম। আমি খুঁজে বের করলাম এর কারণ, আমরা একটা ভাবনা-চিন্তাহীন জীবন যাপন করছি। আমাদের মাথার উপর ছাদ আছে, থাকার জায়গা আছে, তিন বেলা খাবারের চিন্তা নেই, পরনের কাপড় যা প্রয়োজন তার চেয়ে কয়েকগুণ আছে। এই ভাবনা-চিন্তাহীন, আপেক্ষিকভাবে নিরাপদ একটা জীবনে আমাদের কোনো প্রায়োরিটি নেই, কোনো লক্ষ্য নেই, উদ্দেশ্য নেই। আচ্ছা যাদের জীবন আমাদের মতো ভাবনা-চিন্তাহীন নয়, তারা কি চিন্তা করে? তাদের আলোচনার বিষয়বস্তু, তাদের প্রায়োরিটি কি থাকে?
.
এই যেমন ধরুন, চীনের উইগুরের মুসলিমরা, যেখানে বাবা-মা জানে না তাদের সন্তান কোথায়। রোহিঙ্গা মায়ের কথা ধরুন, তার চোখের সামনে সন্তানকে আগুনে নিক্ষেপ করা হচ্ছে, একজন মা নিজের চোখে দেখছেন তার সন্তান আগুনে পুড়ে অঙ্গার হয়ে যাচ্ছে, একই সাথে সেই মা'কে অনেকজন মিলে ধর্ষণ করছে। সিরিয়ার কথা ধরুন, ফসফরাস বোমায় মানুষ পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছে, কিংবা ফিলিস্তিনে দেখুন দিনে দুপুরে নিজেদের ঘরবাড়ি গুড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে, হঠাৎ করে একটি পরিবার জানতে পারল তাদের থাকার কোনো ঘর নেই। আপনি নিশ্চিত থাকতে পারেন এসব মানুষের জীবনের প্রায়োরিটি, আলোচনার বিষয়বস্তু, চেষ্টা সংগ্রাম কোনোটাই আমাদের এই নিশ্চিন্ত জীবনের মতো নয়।
.
মানুষের জীবনে যখন কোনো পরীক্ষা থাকে না, বিপদ থাকে না, অতি জরুরী কোনো বিষয়ে যখন তাকে সংগ্রাম করতে হয় না, তখন এমন এমন বিষয়ে সে ব্যস্ত হয়ে যায়, সময় কাটায়, নিজের প্রায়োরিটি বানায়, অন্য কোনো স্থানে, সময়ে দাঁড়িয়ে কেউ কেউ হয়তো এসব দেখে হাসবে। লক্ষ্যহীন, প্রায়োরিটিহীন সেই জীবন তখন ভালো রেজাল্ট করতে না পেরে আত্মহত্যা করে, সাকিব আল হাসান কেন বিশ্বকাপের ম্যান অব দ্যা টুর্নামেন্ট হলো না, সেটা নিয়ে চায়ের কাপে ঝড় উঠে, এত সাজগোজ করে ছবি দেওয়ার পরও ফেসবুকের প্রফাইল পিকটাতে লাইক কেন কম পড়ল সেটা নিয়ে মন খারাপ হয়। আমাদের মন খারাপ হওয়া, টেনশন করা, কষ্ট পাওয়াগুলো কত্ত সস্তা, অর্থহীন হয়ে যায়।
.
একবার একটা রেস্টুরেন্টে খেতে গিয়েছিলাম। পাশের টেবিলে এক ভদ্রলোক বসেছিলেন, পর্বত সমান শরীরের সাইজ। উনার মেন্যুতে একটু গ্রেভি কম হয়েছিল, আসলে রাতের দিকে প্রায় বন্ধ হওয়ার আগে আগে সময়, গ্রেভি শেষ হিয়ে গিয়েছিল। এরপর সেই ভদ্রলোক অনেকক্ষণ কেন একটু গ্রেভি কম হলো এটা নিয়ে ঝগড়া করলেন, সাথে আরেকটু গ্রেভির জন্য সেই কি আফসোস! আজ আমার এক ডাক্তার বন্ধুর সাথে কথা হচ্ছিল। সে একটা হাসপাতালে ডিউটি দিতে গিয়েছিল, যেখানে বন্যা চলছে। সে বলল, একবার এমন হয়েছে, সকালের নাস্তা করার মতো কিছু নেই, চারদিকে পানি আর পানি, কোনো দোকান নেই। অনেক কষ্টে এক জায়গা থেকে কেক ম্যানেজ করে চালিয়েছে। শুধু একবেলা নাস্তা করতে পারিনি বলে তার কি অবস্থা, আর চিন্তা করুন যারা এই বন্যার পানিতে বসবাস করছে তাদের কি অবস্থা, তারা কীভাবে থাকছে, কীভাবে খাবার পাচ্ছে!
.
মানুষ যদি নিজেদের এই ভাবনা-চিন্তাহীন জীবনটাকে সত্যিকারের দুঃখ-কষ্টে পতিত জীবনগুলোর সাথে তুলনা করা শিখত তাহলে বুঝতে পারত, যেটাকে তারা দুঃখ কষ্ট মনে করছে, যা নিয়ে তারা টেনশন করছে, মরে যাচ্ছে, এসব আসলে প্রয়োজন নয়, বিলাসিতা। অর্থহীন, সস্তা কিছু জিনিস। সবচেয়ে বড় পরীক্ষা হলো ঈমানের পরীক্ষা, সবচেয়ে বড় কষ্ট হলো প্রিয়জন হারানোর কষ্ট, তাও চোখের সামনে, যখন আপনার কিছুই করার নেই। সবচেয়ে বড় টেনশন তো যখন আপনি জানেন আপনার থাকার জায়গা নেই, খাবার নেই, পরনের কাপড় নেই। যার কোনোটাই আমাদের বেশিরভাগের উপর আসেনি। অকৃতজ্ঞ হৃদয়গুলো, লক্ষ্য-উদ্দেশ্যহীন মানুষগুলো তাই অতি তুচ্ছ কারণে টেনশন করে মরছে, অতি সস্তা কারণে কষ্ট পাচ্ছে, অতি অর্থহীন কোনো জিনিস না পেয়ে জীবনটাই দিয়ে দিচ্ছে। আহারে জীবন, আহারে...
------------------------------------------------
--copied
.
আমি অবাক হয়ে খুঁজে বের করার চেষ্টা করলাম এমন কেন হচ্ছে? সামান্য টমেটো আলোচনার বিষয়বস্তু, একটা আলমিরা নিয়ে সবাই ব্যস্ত! আমার মনে হয় আমাদের বেশিরভাগেরই এই অবস্থা। প্রত্যেক ঘরেই কমবেশি এরকম। আমি খুঁজে বের করলাম এর কারণ, আমরা একটা ভাবনা-চিন্তাহীন জীবন যাপন করছি। আমাদের মাথার উপর ছাদ আছে, থাকার জায়গা আছে, তিন বেলা খাবারের চিন্তা নেই, পরনের কাপড় যা প্রয়োজন তার চেয়ে কয়েকগুণ আছে। এই ভাবনা-চিন্তাহীন, আপেক্ষিকভাবে নিরাপদ একটা জীবনে আমাদের কোনো প্রায়োরিটি নেই, কোনো লক্ষ্য নেই, উদ্দেশ্য নেই। আচ্ছা যাদের জীবন আমাদের মতো ভাবনা-চিন্তাহীন নয়, তারা কি চিন্তা করে? তাদের আলোচনার বিষয়বস্তু, তাদের প্রায়োরিটি কি থাকে?
.
এই যেমন ধরুন, চীনের উইগুরের মুসলিমরা, যেখানে বাবা-মা জানে না তাদের সন্তান কোথায়। রোহিঙ্গা মায়ের কথা ধরুন, তার চোখের সামনে সন্তানকে আগুনে নিক্ষেপ করা হচ্ছে, একজন মা নিজের চোখে দেখছেন তার সন্তান আগুনে পুড়ে অঙ্গার হয়ে যাচ্ছে, একই সাথে সেই মা'কে অনেকজন মিলে ধর্ষণ করছে। সিরিয়ার কথা ধরুন, ফসফরাস বোমায় মানুষ পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছে, কিংবা ফিলিস্তিনে দেখুন দিনে দুপুরে নিজেদের ঘরবাড়ি গুড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে, হঠাৎ করে একটি পরিবার জানতে পারল তাদের থাকার কোনো ঘর নেই। আপনি নিশ্চিত থাকতে পারেন এসব মানুষের জীবনের প্রায়োরিটি, আলোচনার বিষয়বস্তু, চেষ্টা সংগ্রাম কোনোটাই আমাদের এই নিশ্চিন্ত জীবনের মতো নয়।
.
মানুষের জীবনে যখন কোনো পরীক্ষা থাকে না, বিপদ থাকে না, অতি জরুরী কোনো বিষয়ে যখন তাকে সংগ্রাম করতে হয় না, তখন এমন এমন বিষয়ে সে ব্যস্ত হয়ে যায়, সময় কাটায়, নিজের প্রায়োরিটি বানায়, অন্য কোনো স্থানে, সময়ে দাঁড়িয়ে কেউ কেউ হয়তো এসব দেখে হাসবে। লক্ষ্যহীন, প্রায়োরিটিহীন সেই জীবন তখন ভালো রেজাল্ট করতে না পেরে আত্মহত্যা করে, সাকিব আল হাসান কেন বিশ্বকাপের ম্যান অব দ্যা টুর্নামেন্ট হলো না, সেটা নিয়ে চায়ের কাপে ঝড় উঠে, এত সাজগোজ করে ছবি দেওয়ার পরও ফেসবুকের প্রফাইল পিকটাতে লাইক কেন কম পড়ল সেটা নিয়ে মন খারাপ হয়। আমাদের মন খারাপ হওয়া, টেনশন করা, কষ্ট পাওয়াগুলো কত্ত সস্তা, অর্থহীন হয়ে যায়।
.
একবার একটা রেস্টুরেন্টে খেতে গিয়েছিলাম। পাশের টেবিলে এক ভদ্রলোক বসেছিলেন, পর্বত সমান শরীরের সাইজ। উনার মেন্যুতে একটু গ্রেভি কম হয়েছিল, আসলে রাতের দিকে প্রায় বন্ধ হওয়ার আগে আগে সময়, গ্রেভি শেষ হিয়ে গিয়েছিল। এরপর সেই ভদ্রলোক অনেকক্ষণ কেন একটু গ্রেভি কম হলো এটা নিয়ে ঝগড়া করলেন, সাথে আরেকটু গ্রেভির জন্য সেই কি আফসোস! আজ আমার এক ডাক্তার বন্ধুর সাথে কথা হচ্ছিল। সে একটা হাসপাতালে ডিউটি দিতে গিয়েছিল, যেখানে বন্যা চলছে। সে বলল, একবার এমন হয়েছে, সকালের নাস্তা করার মতো কিছু নেই, চারদিকে পানি আর পানি, কোনো দোকান নেই। অনেক কষ্টে এক জায়গা থেকে কেক ম্যানেজ করে চালিয়েছে। শুধু একবেলা নাস্তা করতে পারিনি বলে তার কি অবস্থা, আর চিন্তা করুন যারা এই বন্যার পানিতে বসবাস করছে তাদের কি অবস্থা, তারা কীভাবে থাকছে, কীভাবে খাবার পাচ্ছে!
.
মানুষ যদি নিজেদের এই ভাবনা-চিন্তাহীন জীবনটাকে সত্যিকারের দুঃখ-কষ্টে পতিত জীবনগুলোর সাথে তুলনা করা শিখত তাহলে বুঝতে পারত, যেটাকে তারা দুঃখ কষ্ট মনে করছে, যা নিয়ে তারা টেনশন করছে, মরে যাচ্ছে, এসব আসলে প্রয়োজন নয়, বিলাসিতা। অর্থহীন, সস্তা কিছু জিনিস। সবচেয়ে বড় পরীক্ষা হলো ঈমানের পরীক্ষা, সবচেয়ে বড় কষ্ট হলো প্রিয়জন হারানোর কষ্ট, তাও চোখের সামনে, যখন আপনার কিছুই করার নেই। সবচেয়ে বড় টেনশন তো যখন আপনি জানেন আপনার থাকার জায়গা নেই, খাবার নেই, পরনের কাপড় নেই। যার কোনোটাই আমাদের বেশিরভাগের উপর আসেনি। অকৃতজ্ঞ হৃদয়গুলো, লক্ষ্য-উদ্দেশ্যহীন মানুষগুলো তাই অতি তুচ্ছ কারণে টেনশন করে মরছে, অতি সস্তা কারণে কষ্ট পাচ্ছে, অতি অর্থহীন কোনো জিনিস না পেয়ে জীবনটাই দিয়ে দিচ্ছে। আহারে জীবন, আহারে...
------------------------------------------------
--copied