বন্ধুদের মধ্যে যাকেই বিয়ের কথা বলতে যাই, প্রায় সবারই একই প্রশ্ন, 'রিলেশানশীপ কতো বছরের আর পরিচয়ই বা কিভাবে?'
যখন বলি যে রিলেশানশীপ ছিলোনা, অ্যারেঞ্জ ম্যারেজ ছিলো, তখন সবাই বিস্ফোরিত নয়নে বলে, 'বলিস কি? রিলেশানশীপ না হলে এতোদূরে বিয়ে হলো কিভাবে?'
বন্ধুদের একদলের ধারণা, যেহেতু আমি তাদের সবার আগে, ক্যারিয়ার-ট্যারিয়ার গঠন করার আগেই বিয়ে করে ফেলেছি, নিশ্চিত এটা প্রেমঘটিত কোন মামলা। নইলে কোন মেয়ের বাপের শখ হয়েছে যে আমার মতো বেকার এক ছোকরার কাঁধে তাদের রাজকন্যার ভার তুলে দেয়?
তাদের কাছে ক্যারিয়ার মানেই বিসিএস ক্যাডার হওয়া, ব্যাংকের এসি রুমে বসে কম্পিউটার স্ক্রীনে চোখ ডুবিয়ে রাখা, অথবা গলায় টাই ঝুলিয়ে কোন কর্পোরেট অফিসে সকাল নয়টা থেকে বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত ডিউটি করা। এসবের বাইরে আর ক্যারিয়ারই হয় না।
দ্বিতীয় দলের ধারণা, বিয়েটা যেহেতু চট্টগ্রামে করিনি, তাহলে এই বিয়ে নিশ্চয়ই রিলেশানের মাধ্যমে হয়েছে। শুধু বন্ধু কেনো, আমার গোষ্ঠীর দুই-তৃতীয়াংশ আত্মীয়স্বজনেরও একই দাবি। যেহেতু আমি সুদূর উত্তরবঙ্গ থেকে বিয়ে করেছি, এবং বিয়েতে কানাকড়ি পরিমাণও যৌতুক নিই নাই, প্যান্ডেল করি নাই, ধুমধাম হয় নাই, ব্যান্ড-প্যাকেজ হয় নাই, সেহেতু সকল সমীকরণ থেকে একটা জিনিসই বোঝা যায় যে- আমি প্রেম করে বিয়ে করেছি।
এদের অনেকেই আবার বাঁকা চোখে তাকায়। তাকানোর ভাষা হচ্ছে এই, 'হুজুর সাইজা প্রেম করে বেড়ায়। দাঁড়ি-টুপি-জোব্বার ভিতরে সব শয়তানি'।
গত শুক্রবার শ্বশুরবাড়ি গেলাম। আমার ইচ্ছে করছিলো দিনের বেলায় আমার স্ত্রীর সাথে একটু ঘুরতে। আশপাশটা একটু হেঁটে হেঁটে দেখতে। স্ত্রীকে বললাম, 'চলেন একটু ঘুরে আসি বাইরে থেকে'।
ওমা, উনি বেঁকে বসলেন। যাবেন না। জানতে চাইলাম কেনো। বললেন, 'পাড়ার কিছু মহিলারা কানাঘুষা করছে এই বলে যে, আমি নাকি টানা তিন বছর প্রেম করে আপনাকে বিয়ে করেছি'।
ইন্নালিল্লাহি! জানতে চাইলাম, তাদের এমন মনে হওয়ার কারণ কি? উত্তর হিশেবে পেলাম - দূরত্ব। প্রেম নাহলে এতো দূরে বিয়ে দেওয়ার কারণ কি?'
অবাক হলাম! চট্টগ্রাম আর কি এমন আহামরি দূরত্ব! মানুষের ভাব দেখে মনে হচ্ছে- চট্টগ্রামে নয়, বিয়েটা যেন পৃথিবী টু মঙ্গল গ্রহে হয়েছে।
আমার স্ত্রীকেও একগাদা অপবাদ সহ্য করতে হয়েছে। বোরকা পরেও প্রেম-ভালোবাসা করে, ফষ্টিনষ্টি করে.... হ্যানত্যান।
চট্টগ্রামের ছেলেকে চট্টগ্রামের মেয়ে বিয়ে করতে হবে, সিলেটের মেয়ের সাথে রাজশাহীর ছেলের বিয়ে হতে পারেনা টাইপ কুসংস্কার এখনো আমাদের সমাজে ভালোমতোই শিকড় গেঁড়ে আছে। এই নিয়ম, রীতি-নীতি থেকে কেউ বাইরে আসার চেষ্টা করলেই তার সততা নিয়ে প্রশ্ন উঠে।
সমাজ তখন তার ভালোমানুষিটাকে ভাবে শয়তানি, ভদ্রতাকে ভাবে নোংরামি, নম্রতাকে ভাবে ছ্যাবলামি। মানুষ তার নিজের ভাবনা আর চিন্তা দিয়ে সহজেই অন্যকে জাজ করে ফেলে।
এই ধারণা হয়তো কিছু মানুষের মাঝে সারাজীবন রয়ে যাবে। জনে জনে গিয়ে বোঝানো তো আর সম্ভব নয় যে- আমি প্রেম করে বিয়ে করিনি। একজন মুমিন বিবাহের পূর্বে কোন মহিলার সাথে কোনো ধরণের সম্পর্ক পাতাতে পারেনা। অপ্রয়োজনে কথা বলতে পারেনা। কোন মহিলার দিকে চোখ তুলে তাকাতে পারেনা। চোখ গেলেই নামিয়ে ফেলে। দ্বিতীয়বার তাকায় না।
একজন মুমিন অবশ্যই মনের পর্দার সাথে সাথে দেহের পর্দাও করে। জবানের পর্দাও করে। দৃষ্টি এবং শ্রবণের পর্দাও করে।
তার ভালোমানুষিটা সত্যি সত্যিই ভালো হওয়ার চেষ্টা, ভন্ডামি নয়।
দ্বীন মানবে আবার হারাম রিলেশানশীপও করবে- এমন ডাবল স্ট্যান্ডবাজি নিয়ে একজন মুমিন চলতে পারেনা।
---- আরিফ আজাদ